‘ফুটানি ছাড়েন’
|
৬ কার্তিক ১৪২৯ |
Friday, October 21, 2022
পৃথিবীতে কেউ আপনার সুখের দায়িত্ব নিয়ে বসে নেই,আপনার সুখের জন্যে আপনাকেই পরিশ্রম করতে হবে, আয় করতে হবে। যেমন আয় করবেন তেমন ব্যায় করতে হবে; অপচয় করা যাবে না। মৃতব্যয়ী হতে হবে। তাহলে জীবনটা সুন্দর হবে। এ প্রসংগে একটি পারিবারিক বিষয় আলোনায় আনলাম।
হানিফ চাচাকে সেন্ডেল কিংবা জুতা পড়তে দেখিনি কখনো। প্যান্ট আর পাজামাতো নয়ই। তিনি আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন। তবে তাঁকে আমরা কাজের লোক ভাবিনি কখনো। বয়বৃদ্ধ হওয়ায় বাড়ির সবাই তাকে অত্যন্ত সম্মান দিয়ে চলতেন। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে আপন চাচার মতই। গরুর দুধ দোয়ানো আর লালন পালন ছিলো তার প্রধান কাজ। সেসুবাদে আমাদের ছাই রঙ্গের একটি গরুর সাথে তখন দিন রাত তাঁর এত শখ্য ছিলো যে, গরুটা যেন একসময় চাচার বন্ধু বনে গিয়েছিলো। হানিফ চাচা খুব আদর যত্ন করে গরুটাকে পালতেন। দাদা সুবেদ আলী মীরের আবার দু’বেলা গরুর দুধ না হল চলতোই না। তাও আবার তার খাঁটি দুধ চাই। সাথে লাগতো আড়াইহাজারের বড় বিনার চরের খাঁটি দানাদার আখের গুঁড়। দাদা ঐ গরুটা পালতেন খাঁটি দুধের আশায়। তিনি নিজে খাঁটি দুধ খেয়ে যেমন শান্তি পেতেন, আমাদের খাইয়েও তার যেন সুখের সীমা ছিলো না। সেই ৩৩/৩৪ বছর আগের কথা। হানিফ চাচা তখনই অশতিপর বৃদ্ধ। গরু পালা ছাড়া তাঁর আর কোন কাজ করার ক্ষমতা ছিলো না।
চাচার একদিন সখ হলো বিমানে চড়ে যশোর যাবেন। তাও আবার নিজের টাকায়। বেতনের জমানো টাকা থেকেই চাচার আমার সখ হলো মৃত্যুর আগে তিনি একবার বিমানে চড়বেন। সখের তোলা ৮০ টাকা বলে কথা। চাচার ইচ্ছায় বাঁধ সাধলো না কেউ। পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত হলো চাচা বিমানে যাবেন সাথে আমার বাবাও যাবেন তাঁর সাথে। চাচা আর বাবা যথা সময়ে বিমানে উঠে বসলেন। বাগড়া দিলেন চাচা। ‘এত্তবড় বাড়িডা আকাশে উঠবো কেমনে? পইরা যাইবনাতো?’ ধুঁরু ধুরু চাচার বুক। ভয়ের মাঝেই বিমান আকাশে উড়লো। বিমান বালা সবাইকে যথাসময় নাস্তা দিলেন। ধব্ ধবে টিসুটাই চাচার বেশী পছন্দের মনে হলো। টিসু হাতে নিয়ে চাচা আমার চুষতে লাগলেন। মজা পেলেন না। বাবা বুঝালেন এটা খাবার জিনিস নয়। লজ্জা পেলেন চাচা। কাচুমুচু করে মুখ ঘুরালেন। মিনিট ৩০ পরে তাদের নামতে হলো বিমান থেকে। সেখান থেকে সোজা গেলেন আমার পিতার কর্মস্থলে। সাথেই তারা কোয়াটার। তিনি তখন পাট গবেষনা ইনিষ্টিটউটের বৈজ্ঞানীক কর্মকর্তা। সেখানে দু’চার দিন থাকার পর বাসে চড়ে হানিয় চাচা আবার নারায়ণগঞ্জের বাড়ি ফিরলেন। গরু নিয়ে ফের মেতে উঠলেন। বছর খানেক বিমানের এই গল্প করতে করতেই চাচার সময় কেটে যেতো। এর পরও যেন গল্পের শেষ নেই। এ স্মৃতি নিয়িই বছর না গড়াতেই চাচা আমরা একদিন দুনিয়া ছাড়লেন। মরহুম চাচার সখটাকে আমি অসম্মান জানাতে চাই না। কারণ বিমানে চড়ার সখ ছাড়া তাকে আর কখনো কোন কিছুতেই বাড়াবাড়ি করতে দেখিনি। তবে এ সমাজের অনেকেই আছেন যারা সঙ্গতির সাথে চলতে চান না। আয় বুঝে ব্যায় করেন না। অন্যের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজেকে নিশ্বেষ করে দেন। হাতে কিছু টাকা থাকলে খরচের বিষয়ে লাগামহীন হয়ে পড়েন। এটা ঠিক নয়। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে খরচের বিষয়ে লাগাম থাকা উচিত। তাই আমার দাদার মতো করে বলব- ‘আয় বুঝে খরচ কর এবং সঞ্চয়ী হও’।
ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হবে আপনাকেই। সময়ের সঠিক মূল্যায়ন করুন। আয় বুঝে ব্যায় কথাটা অনেক পুরোনো হলেও ফেলনা নয়। তাই করুন, ভবিষ্যত ভালো হবে বলতে পারি। তবে আমার উল্টো আরেকটা সাজেশন হলো, সব সময় আয় বুঝে কিপটেমি করতে থাকলে আপনি একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবেন। তাই মাঝে মাঝে ব্যায় এবং আয় দুইটাই বাড়ানোর চেষ্টা করুন। অপচয় অবশ্যই সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখুন। আয়ের উৎস একাধিক বাড়ান। মাঝে মাঝে ঝুঁকি নিন। কিন্তু নিজের সর্বস্ব বাজি রেখে ঝুকি নেয়া বোকামী। সব কাজের বিকল্প রাস্তা আগেই খুঁজে রাখুন। সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে আগে খরচ করে তারপর বাকিটা সঞ্চয় না করে আগে প্রযেজনীয় অংশটা সঞ্চয় করুন, তারপর বাদ বাকি খরচ করুন। যতোটা আয় করছেন তার সাথে হিসাব মিলিয়ে নিয়ে ব্যয়ের হিসাবটাও করে ফেলুন। কারণ আপনি হয়তো অন্যকে দেখে নিজের আয়ের চাইতে বেশি খরচ করে ফেললেন, কিন্তু এতে পরবর্তীতে আপনি নিজে যে অর্থ সংকটে পড়বেন তা আপনার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। তাই জীবনকে সহজ রাখতে চাইলে ঠিকঠ্কা মতো হিসাব রাখুন। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে, নিজের ভাগ্যের ওপর বিশ্বাস রেখে এবং নিজের সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস রেখে তবেই কাজ করুন, দেখবেন মনে প্রশান্তি আসবে। আয় রোজগারও বাড়বে। ব্যায় করুন বুঝেসুজে। আর তাতে জীবন হয়ে উঠবে খুব সহজ।
এ লিখাটা লিখতে গিয়ে দাদার কথা খুব মনে পরছে। দাদা ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ছোট বেলায় দাদার সাথে এক বিছনায় দিনের পর দিন ঘুমিয়েছি। মৃতুর দিনও ১২৩ বছর বয়সে তার হাতে লাঠি থাকলেও তাতে ভর করতে দেখিনি; বিনে চশমায় পত্রিকা আর কোরান,হাদিসের বই অনর্গল পড়তে পারতেন। একটু কিপটে স্বভাবের ছিলেন। মৃতব্যায়ী আরকি। আগের দিনের মানুষ যেমন ছিলো ঠিক তেমন। দাদা পাটের ব্যবসা করতেন। জমিজিরাত ভালই ছিলো; গিরস্থি ছিলো ভরপুর। তখনকার সময়ে বেশ টাকা-কঁড়ি কামাই করলেও খরচ করতেন খুব হিসাব করে। বিনা কারণে কাউকে একটা টাকা বেশি দিতেন না। সব জায়গায় দরদাম করতেন। ঘুরে ঘুরে সদাইপাতি কিনতেন। মাঝে মঝে আমি তাঁর সাথে নিকটস্থ্য রূপগঞ্জের রূপসী বাজারে বাজার করতে যেতাম। আসার সময় অনেক অনুরোধ করতাম রিক্সা নেয়া জন্য। দাদা নিতে চাইতেন না। বলতেন ‘জোড়ে জোড়ে হাঁট নাতী; ব্যায়াম হইবো।’ বলতেন- ‘ঠিক আছে, বাজারের ব্যাগটা না হয় আমারে দে’। আমি দিতে চাইতাম না। বড় ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে হেঁটে হেটেই বাড়ী আসতাম। মৃতব্যায়ী হলেও দাদা আমাদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়া জন্য প্রচুর উপহার দিতেন। ভালো খাবার কিনতে এসব ব্যাপারে তাকে কিপটেমি করতে দেখিনি কখনো। খাবার দাবারের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। অতিথি আপ্যায়নে ছিলেন বেশ সচেতন। মানুষকে খাইয়ে মজা পেতেন। দাদার কাছে শিখেছি, স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভালো ভালো খাবার খেতে হবে। দাদাও খাদ্য খাবারের ব্যাপারে ছিলেন বেশ উদারহস্ত। দাদা আমার কাছে ছিলেন এক অসাধারন মানুষ। খুব ধার্মিক ও সৎ লোক। পুরো এলাকার বিচারাচার করতেন। চেয়ারম্যান মেম্বার না হলেও এলাকাবাসী তাকে বেশ সমিহ করতো। তিনি প্রায়ই বলতেন- ‘অপচয় করবি না কখনো’। কখনো ভাত টেবিলে পরলে কুঁড়িয়ে খেতে নির্দেশ দিতেন। বেশী খেতে মানা নেই, কিন্তু কখনও খাবার নষ্ট করতে দেখলে প্রচন্ড ক্ষেপে যেতেন। তিনি খুব বেশি শিক্ষিত না হলেও মাঝে সাজে দু’একটা ইংরেজি বেশ শুদ্ধ ভাবেই বলতেন। দাদার প্রায়ই ইংরেজিতে বলতেন-‘কাট ইউর কোট একোর্ডিং টু ইউর ক্লথ’। তার কন্ঠে ইরেজি শব্দ শুনতে বেশ ভালোই লাগতো। তখন এই ইংরেজির বাংলা বুঝলেও ভাবার্থ আমার মাথায় ঢুকত না। খুব ছোট ছিলামতো তাই ভাবতাম দরর্জিদের কাজ আমরা করতে যাব কেন? তাছাড়া শরীর মেপেইতো কোট বানাতে হবে, কাপড় অনুযায়ী কোট বানালে কি শরীরে আসবে? এখন বড় হয়েছি, দাদা কি বলতে চেয়েছেন তা বেশ বুঝি। ভাবি দাদার মতো কি চলতে পারি? আমাদের মতো উড়ালচন্ডিদের কথা চিন্তা করেই বোধেহয় কোম্পানীগুলো ক্রডিট কার্ড চালু করেছে। ‘খরচ আগে কর; পয়সা পরে দিলেও চলবে’। আমরাও খরচ করছি দেদারছে। ভবিষ্যতের কথা ভাবছি ক’জন? দাদা একটি যৌথ পরিবার চালিয়েছিলেন। বলা যায় তার চিন্তা চেতনায় একটা পাড়া চলতো। আর আমরা এখন নিজেই চলেত হিমসীম খাই। বুঝি, যদি দাদার ঐ নীতিটা মানা যেত তাহলে ভালোই হত।
“আয় বুঝে ব্যায় কর” এই নীতি সে সময় আমাদের বাপ দাদারা ঠিকই মেনে চলতেন; আমরা পারিনা কেন? তখন তাঁরা ঋণও করতেন না খুব একটা। হিসাব করেই জীবন পার করে দিতেন। আমরা মোটেও তা পারি না। আমাদের রাষ্ট্রও কি আয় বুঝে ব্যায় করতে পারছে? রাষ্ট্রেরই তো মাথাপিছু অনেক দেনা। নতুন নতুন অভাব তৈরী হচ্ছে দিন দিন। লোন করা ছাড়াতো কিছুই সম্ভব না। ব্যবসা, উৎপাদন, সবকিছুতেই ঋণ আর ঋণ। ঋণ করা আমাদের যেন অভ্যাস হয়ে গেছে। এ স্বভাব বদলাতে হবে, নইলে আমাদের কপালে যেমন দুর্গতি আছে, রাষ্ট্রকের পড়তে হবে মহা বিপাকে। এটা মোটেও সুখকর নয়।