বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি) ডুবছে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী ফিরোজ হোসেনের হাতে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে নিজে বিটিএমসির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলি-সবকিছুতেই তার হস্তক্ষেপ। ফলে সংস্থাটি একজনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিটিএমসির সাবেক চেয়ারম্যান পীরজাদা শহিদুল হকসহ বেশ কয়েকজন যুগান্তরকে বলেছেন, ভারপ্রাপ্ত সচিব একজন উপসচিবের পদমর্যাদার কর্মকর্তা। অথচ সরকারের পূর্ণ সচিবের মতো ক্ষমতা দেখাতে চান। এটা করতে গিয়ে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন।
সম্প্রতি বিটিএমসির সাবেক চেয়ারম্যান পীরজাদা শহিদুল হকসহ আরও দুজন সাবেক সচিব কাজী ফিরোজ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দেন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ফিরোজ হোসেনের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ চলছে। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অবৈধ হস্তক্ষেপ, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনসহ অস্বাভাবিক মূল্যে বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটার অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদক যাচাই-বাছাই করছে।
১৯৭২ সালে গঠিত হয় বিটিএমসি। একজন চেয়ারম্যান ও তিনজন পরিচালকের সমন্বয়ে পরিচালনা পর্ষদ (বোর্ড) থাকার কথা। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে সেইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির নিয়োগ, পদোন্নতি, অফিস ভাড়াসহ সব কর্মকাণ্ড এ বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে ২০১৮ সালে এর ব্যত্যয় ঘটে। ওই বছরের জুনে তৎকালীন ডিজিএম (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সচিব) কাজী ফিরোজ হোসেন পদোন্নতি, অফিস ভাড়া, গাড়ি কেনাসহ নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। এতে সফল হলেও তৎকালীন পরিচালক (বাণিজ্য) ও পরিচালক (অপারেশন)-কে প্রলুব্ধ করতে ব্যর্থ হন তিনি। এ কারণে তাদের বিটিএমসি থেকে বদলির ব্যবস্থা করেন। এমনকি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কিছু অসৎ কর্মকর্তার সহায়তায় বিটিএমসিতে কোনো পরিচালক ও সচিব নিয়োগ করতে দেননি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বোর্ড অচল হয়ে আছে।
দুদকে দাখিল করা অভিযোগে আরও বলা হয়, ফিরোজ হোসেনের নেতৃত্বে একটি চক্র বিটিএমসিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। তিনি বিধিবহির্ভূতভাবে নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আর প্রতিষ্ঠান ক্রমশ নিচের দিকে নামছে। বিটিএমসি ভবনের ১৩তলায় নির্মিত রেইনরফ হোটেলটি ২০১৮ সালের ২৮ মে চালু না করার সিদ্ধান্ত হয়। হোটেলটি নির্মাণে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল এভিয়েশনের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। অথচ বোর্ড না থাকায় একক ক্ষমতাবলে কাজী ফিরোজ হোসেন মোটা টাকায় গত বছরের মার্চে বেআইনিভাবে রেইনরফ হোটেল চালু করেন।
ফিরোজ হোসেনের বিরুদ্ধে পদোন্নতি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে তিনি সব সময় পরিচালকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ও বোর্ডের সুপারিশ বা নিয়মনীতি উপেক্ষা করেন। সিনিয়রদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জুনিয়র কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করেন নিজের খেয়ালখুশিমতো। অথচ প্রচলিত আইন অনুযায়ী, জুনিয়র কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কমিটি কখনো সিনিয়র কর্মকর্তার পদোন্নতি দিতে পারেন না। জুনিয়র কর্মকর্তাদের নিয়ে পদোন্নতি বাণিজ্য করে তিনি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হয়। জিএম পদে ২০১৬ সালে তার পদোন্নতিও হয় একদিনেই।
অভিযোগে বলা হয়, পিপিপির প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ঢাকার ডেমরার আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিলস ও গাজীপুরের টঙ্গীর কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলসের স্থাপনাসহ যন্ত্রাংশ ও নানা জিনিসপত্র বিক্রিতে ঘুষ নিয়েছেন কাজী ফিরোজ হোসেন। সাধারণত কারখানার যন্ত্রাংশ ও স্থাপনার দাম নির্ধারণের জন্য সিএ ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তা করা হলেও সেই সিএ ফার্মের পরামর্শ বাদ দিয়ে কাজী ফিরোজ তার মনোনীত কর্মকর্তাদের দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন। পরে সিএ ফার্মের প্রস্তাবিত মূল্যের চেয়ে কম ধার্য করে মিল দুটি লিজ দেওয়া হয়। আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিলের ইনচার্জ এর প্রতিবাদ করলে তাকে শাস্তিস্বরূপ খুলনা টেক্সটাইল মিলে বদলি করা হয়। তার বিরুদ্ধাচরণ করলে এভাবে শাস্তিস্বরূপ অন্যদেরও বদলি করেন তিনি।
আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিল পিপিপি গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান। অথচ প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত জামানতের টাকা বিটিএমসিতে জমা দেয়নি। জামানতের পুরো অর্থ কাজী ফিরোজ ও আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিলস আত্মসাৎ করেছে কি না, তা-ও অনুসন্ধান করতে বলা হয় অভিযোগে। আহমেদ বাওয়ানী জুট মিলের লিজগ্রহীতা একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে কাজী ফিরোজ হোসেনের পরিবারও ইউরোপ ট্যুর করে।
সরকারি গাড়ি কেনার জন্য অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। বিষয়টি গোপন রেখে চলতি বছর কাজী ফিরোজ হোসেনের সহায়তায় একটি কার ও দুটি মাইক্রো কেনা হয়েছে। শুধু গাড়ি-ই নয়, অবৈধ পন্থায় গাড়িচালকও নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। যেসব কারখানায় গাড়িই নেই, অবৈধ সুবিধা নিয়ে তিনজন গাড়িচালককে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন। দিনপ্রতি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধ রয়েছে। সেই নিয়ম না মেনে বিভিন্ন সময়ে বিটিএমসির অবসরপ্রাপ্ত ২০ থেকে ২২ জনকে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ দেন তিনি।
কেনাকাটায় বেপরোয়া কাজী ফিরোজ হোসেন। বোর্ডের অনুমোদন না থাকলেও নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত বোর্ডে জিএম পদ বহাল রেখেছেন। সচিবের কক্ষ ব্যবহার করছেন তিনি। যেখানে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে একটি চেয়ার কেনেন। একই সঙ্গে বিপুল অর্থব্যয়ে রুমটি আধুনিকায়ন করেন।
নিজেকে ক্যাডার সার্ভিসের একজন পূর্ণাঙ্গ সচিব হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কাজী ফিরোজ। এ লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে একাধিক বাংলা ও ইংরেজি সিল রয়েছে তার। তিনি তার নিজের অফিস কক্ষ ব্যবহার না করে সচিবের কক্ষ ব্যবহার করছেন এবং নেমপ্লেট ব্যবহার করেছেন।
দুদকে অভিযোগ দায়েরের বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিএমসির সাবেক চেয়ারম্যান পীরজাদা শহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, যে অভিযোগটি করেছি, এর প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অভিযোগকারীদের মধ্যে আমি ও সাবেক দুজন পরিচালকের নাম রয়েছে। এটা ঠিক যে, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সচিব বেশ বেপরোয়া। আমি মনে করি, তার হাতেই ডুবছে বিটিএমসি। কাগজপত্রেই দেখা যাবে, বিটিএমসির দোকান ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমি চেয়ারম্যান থাকাকালে দ্বিমতপোষণ করেছিলাম। আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সব সদস্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভাড়া দেওয়া যাবে না। কিন্তু এটা বন্ধ করার জন্য পরে ওই রেজুলেশন তারা (ভারপ্রাপ্ত সচিব) সরিয়ে ফেলেছে। এর কারণ হচ্ছে-এই বিটিএমসি ভবনের কাছেই সোনারগাঁও হোটেল। ওই এলাকা কিন্তু অগ্নিপ্রবণ। এনটিভিতে আগুন লেগেছে, আরটিভিতে আগুন লেগেছে। ওখানে গ্যাসের লাইন থেকে আগুন লাগলে কী হবে, আমরা জানি। আইনে বলা আছে, বিটিএমসির ছাদটা একদম উন্মুক্ত রাখতে হবে। আমরা ছাদটি উন্মুক্ত রেখেছিলাম। কিন্তু কোনো সরকারি সংস্থার অনুমতি ছাড়াই সেখানে রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এমনকি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল এভিয়েশনেরও অনুমতি নেওয়া হয়নি। রাজউক এখানে ১২ তলা পর্যন্ত অনুমোদন দেয়। তার ওপর আরও একতলা কীভাবে হলো, দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে আশা করি।
সাবেক এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, কাউকে যখন প্রমোশন দেওয়া হবে, তখন তার সিনিয়রদের সেই বোর্ডে থাকতে হবে। যেমন আমরা অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি। সচিবের প্রমোশন বোর্ডে থাকতে পারব না। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটান কাজী ফিরোজ হোসেন। আরপিও ২৭-এ-ও বিষয়টি বলা আছে। এভাবে অনেক কাজই অবৈধভাবে করে যাচ্ছেন তিনি। একটা জিনিস দেখলাম, ফিরোজ তার বাসায় নেমপ্লেটে লিখছে ‘সচিব বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়’। অথচ ফিরোজ উপসচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা। ভারপ্রাপ্ত সচিব আহমেদ বাওয়ানী জুট মিলসের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত সরকারের ২৫ কোটি টাকা আদায় করতে পারেননি তিনি। এই এক বছরে ২৫ কোটি টাকা যদি ব্যাংকে থাকত, তাহলে ২৫ লাখ টাকার বেশি আসত। এ খাতে টাকা সরকারি কোষাগারে না গেলেও তার পকেটে উঠছে। রাঙামাটি টেক্সটাইল মিল, সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল, সাতক্ষীরা টেক্সটাইল মিলসহ চিটাগাং টেক্সটাইল মিল-যেখানে কোনো গাড়ি নেই, সেখানে পদ খালি করে টাকার বিনিময়ে চালক নিয়েছেন। আমি এটাকে সমর্থন করি না। আমি বিটিএমসির নাড়িনক্ষত্র জানি। কীভাবে একজন ভারপ্রাপ্ত সচিব ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে চেয়ার কেনেন?
এই বিষয়গুলো অনুসন্ধান হতেই হবে রাষ্ট্রের স্বার্থে। বর্তমান চেয়াররম্যানকেও অনেক সময় অনেক কিছু জানানো হয় না। ২০১৮ সালের ২৮ মে সর্বসম্মত পঞ্চম বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন এই র্ফিরোজরা।
এদিকে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাজী ফিরোজ হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সচিব হচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেড। অবৈধ রেস্টুরেন্টের বিষয়ে তিনি বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি আসায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু কোন ক্ষমতাবলে, কোন কোন দপ্তরের অনুমোদন নিয়ে ১৩তলায় চালু করলেন, এর কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তবে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই বছর পর রেস্টুরেন্টটি মিনিস্ট্রি অব টেক্সটাইলস আবার খুলে দেয় বলে জানান তিনি। রেস্টুরেন্টে তার শেয়ার থাকার অভিযোগের বিষয়ে বলেন, অনেকেরই শেয়ার আছে। তবে আমার নেই।
তিনি বলেন, আমি হচ্ছি সাময়িক ভারপ্রাপ্ত। যে কোনো সময় সচিব পদায়ন করা হবে। আমি ‘ফর দ্য টাইম বিং’-এ কেয়ারটেকার পোস্ট। যদিও আমি তিন নম্বর গ্রেট সেলারি ড্র করছি। তিনি জানান, বিটিএমসির ২৫টা টেক্সটাইল মিল। এর মধ্যে ২৫টিই বন্ধ। তাহলে সেগুলো কেন আছে বা কেন সরকারের টাকা পড়ে আছে? কেন বেতন দেওয়া হচ্ছে, তিনি এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, বিদ্যমান জনবলের মধ্যে কোনো কারণে যদি একজন ম্যানেজার এরপর জুনিয়র অফিসার মাইন্ড করেন, গোপনে একটা চিঠি লেখে বেনামে মিনিস্ট্রিতে দরখাস্ত লিখেন, এখানে ওখানে দেন, তা আমার কী করার আছে। আমি তাদের নিবৃত করার আর কোনো পথ পাচ্ছি না। আপনার একক সিদ্ধান্তে বিটিএমসিতে অনেক কিছু পালটে যায়-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা কি সম্ভব, আদৌ সম্ভব?
আহমেদ বাওয়ানী মিলের ইজারাদার হাসান মজিদের সঙ্গে ইউরোপ ট্যুরের বিষয়ে তিনি বলেন বিষয়টি মন্ত্রণালয় জানে। নিজে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে বাসার সামনে নেমপ্লেট লাগাননি বা ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে নিজের চেয়ার কেনেননি বলে দাবি করেন।